রেল পিছিয়ে পাঁচ কারণে

সড়কপথের তুলনায় নিরাপদ গণপরিবহন রেল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত এ পরিবহন খাতের বিবর্ণদশা বর্তমানে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে দুর্নীতি, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, জনবল সংকট এবং দূরদর্শিতার অভাবে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এসব সমস্যা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে তার সমাধানে সুপারিশ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১২ মমিনুর রহমানের পাঠানো চিঠির পর ব্যবস্থা নিতে রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, আমি প্রতিবেদনটি দেখেছি। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে রেলওয়ের বর্তমান বেহাল দশা।

শিডিউল মেনে ট্রেন না চলা, যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়া, কোচ অর্থাৎ বগিগুলোর দুরবস্থা, সিংহভাগ ইঞ্জিনের আয়ু ক্ষয়ে যাওয়া, সংশ্লিষ্ট একটি দুষ্টচক্রের দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি কারণে রেলের অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় হয়ে পড়ছে। যাত্রী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কোচগুলো মেরামত করে ব্যবহার করা হলেও এগুলো নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ট্রেনের বগির অতিপরিচিত দৃশ্য হচ্ছে জানালা নেই, দরজা ভাঙা, বিকল ফ্যান, বাথরুমের করুণ অবস্থা। অতিরিক্ত হকারের চাপ, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসা এবং টিকিট কালোবাজারির মধ্যেই চলছে রেল। কমলাপুর স্টেশন থেকে দূর-দূরান্তে রওনা হওয়া ট্রেন প্রায়ই পথে বিকল হয়ে পড়ে। বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। ইঞ্জিন পরিবর্তন করে এক থেকে দু ঘণ্টা দেরি করে ট্রেন ছাড়ে। এমন অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-দিনাজপুরসহ অধিকাংশ রুটে। রেলের আয়ের একটা বড় অংশ পণ্য পরিবহন।

অভিযোগ আছে, পরিকল্পনা ও যথাযথ পরিচালনাগত ত্রুটির কারণে মালামাল বহনে রেল ক্রমেই গৌণ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বিপুল অর্থ খরচ করে চীন থেকে আনা হয় ডেমু ট্রেন। মাত্র সাড়ে চার বছরে আমদানিকৃত এসব ডেমুর অধিকাংশ অচল। পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে ৭টি ডেমু ট্রেন। এগুলো মেরামতের দক্ষতা আমাদের নেই। সূত্রমতে, রেলের দুটি ওয়ার্কশপ আছে। সেখানে মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইঞ্জিন-বগি অকেজো হচ্ছে। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নি¤œমানের যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। অথচ ওয়ার্কশপে মেরামত করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় সম্ভব হতো। রেলের অন্যতম সমস্যা টিকিট কালোবাজারি।

কমলাপুর, বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কৌশলে টিকিট কালোবাজারি করে। অনলাইনে টিকিট আপলোড করার ৩০ মিনিট পরও সাধারণ যাত্রীরা টিকিট পান না। বলা হয়, সব টিকিট শেষ। অথচ কালোবাজারে চড়া দামে টিকিট মেলে। প্রত্যেক আন্তঃনগর ট্রেনে খাবার গাড়ি থাকে। এখানেও সিন্ডিকেট রয়েছে। লোকাল ও মেইল ট্রেনে হকারের উৎপাত বেশি। ভৈরব, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় এদের আধিক্য চোখে পড়ে। এদের একটা অংশ চুরি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। ট্রেনের মধ্যে ওয়াশরুম বা টয়লেটের সমস্যা প্রকট। মহিলা ও শিশুরা এ কারণে বেশ বিপাকে পড়েন। ট্রেনের বড় সমস্যা হচ্ছে টিকিট চেকারদের হয়রানি।

জরিমানা আদায়ের রসিদ বই হাতে থাকলেও এরা আদায়কৃত টাকা পকেটে রাখে। আছে রেলের লাভ-লোকসান নিয়ে অস্পষ্টতা। যাত্রীদের ভিড় থাকলেও লোকসানের মাত্রা কমে না। রেলের এসব সমস্যা সমাধানে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, নতুন বগি সংযোজনের ক্ষেত্রে গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। চলমান ট্রেনের ফ্যান, লাইট, জানালা, টয়লেট রুম, আসনসহ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হওয়া দরকার। রেলের পরিত্যক্ত ও বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করে সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। সর্বোপরি রেলের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করে অভিজ্ঞদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। পাশাপাশি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে মত দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

আপনি আরও পড়তে পারেন